দীর্ঘদিন ধরে সাহস সঞ্চয় করে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে লিখবো বলে গোঁ ধরে ছিলাম অথচ অগত্যা এ সংক্রান্ত দু চারটি গ্রন্থ, দীর্ঘদিনের পত্রিকা পাঠ, দেশের সকল অবস্থা নিজের মনের ভেতর পর্যালোচনা করে লেখায় হাত দিলাম। এক শ্রেণি আমাকে সুশীল বলে গালমন্দ বা উপহাস করতে পারে এতে আমি ক্ষণ বিচলিত নই। এত বড় একটি বিষয়ে লেখায় হাত দিয়েছি বলে আমাকে অতিমাত্রায় উৎসাহী বলে ঠাট্টা করতে পারেন। তথাপি ছাত্র হয়ে বিজ্ঞ মানুষদের সম্পর্কে আমার এ লেখা হঠকারিতা মনে না করার বিনীত অনুরোধ করছি। মূখ্যত এ লেখাটি আমি ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন বিন্যাস এবং এডওয়ার্ড সাঈদের The Representation of Intellectual দ্বারা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। বিনয়ের সহীত বলছি এটিকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বলে কটাক্ষ করবেন না।
বিসমিল্লায় আমি বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে আলোচনা করবো সাঈদ ও ছফা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তবে কোনটি সাঈদের এবং কোনটি ছফার সে সম্পর্কে পাদটিকা থাকবেনা। সাইদ এবং ছফাসহ পশ্চিমা দার্শনিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে আমার বিশ্লেষণ উল্লেখ করবো। আহমদ ছফা তার উক্ত গ্রন্থটি প্রথমে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় এবং তিনি এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন ১৯৯৭ সনে। তিনি বলছেন তার এ গ্রন্থের প্রভাব বাহাত্তর সালে যেমন ছিলো সাতানব্বই সনে এর প্রতিপত্তি অধিকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি তাঁর জীবনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক রোষানলে ছিলেন। ঠিক তেমনি এডওয়ার্ড ডাব্লিউ সাঈদ(১৯৩৫-২০০৩) তার ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থ লেখার পর প্রাচ্যবাদী শাদাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রোধের শিকার হয়েছেন। সাঈদের The Representation of Intellectual গ্রন্থটি সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন এর বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। তার এ গ্রন্থটি মূলত বিবিসি প্রভাবশালী রেইথ বক্তৃতার সংকলন। তিনি ফিলিস্তিনি তে জন্মগ্রহণ করেন খ্রিষ্টান পরিবারে। তবে জীবনের প্রথম সেরা অংশ কাটিয়েছেন ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনে। পরবর্তীতে তিনি মিশর নির্বাসিত হয়ে শিক্ষা সমাপ্তি করে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ইংরেজী সাহিত্যের প্রফেসর হিশেবে বাকী জীবন কাটান। তাছাড়া তিনি ফিলিস্তিনের সংসদের বিদেশ সাংসদ হিশেবে ভূমিকা পালন করেন। আমি তার ও ছফার শীর্ষক গ্রন্থ দ্বারা বাংলাদেশের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করবো।
১।
Intellectual শব্দটির যথার্থ অর্থ বুদ্ধিজীবী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে সেটি নিয়ে চুপ থাকছি। কিন্তু বাংলাদেশে একবারেই কি কোন Intellectuals বা বুদ্ধিজীবী আছে কিনা তা নিয়ে আমি সংশয় প্রকাশ করছিনা। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক,সাংবাদিকেরা কি প্রকৃত বুদ্ধিজীবী কিনা এটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ বেড়েছে পঠিত দুটি গ্রন্থ দ্বারা। বাস্তবিক অর্থে বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে আছে কিনা? থাকলে জাতির দুর্ভোগে, অস্থিরতায় ভূমিকা কি? এ নিয়ে আমি অল্পবিস্তর বাক্যালাপ করবো। শুরুতেই পাশ্চাত্য দার্শনিকদের বুদ্ধিজীবী নিয়ে কি আলাপ আছে তার বিবরণ দেই। কারণ পাশ্চাত্যের রেফারেন্স থাকলে আমাদের ভৃত্য বাঙ্গালীদের সাথে তর্ক করা যায়।
ক) ফরাসি দার্সশনিক জুলিয়ান বেন্দা তার “বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাসঘাতকতা” গ্রন্থে বলছেন, “প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ড ব্যাবহারিক উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য করে না। তারা আনন্দ খোজে শিল্প, বিজ্ঞান কিংবা দর্শনের মধ্যে। এককথায় বলতে গেলে তারা অবস্তুগত সুযোগ সুবিধা সম্বন্ধ করে”। সাঈদ বলছেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা কখনো অধিবিদ্যা ও ন্যায় অনাকাঙ্ক্ষিত নীতির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেনা। তারা দুর্নীতির নিন্দা জানায়, দূর্বলকে রক্ষা করে। অন্যায় ও শোষনমূলক শাসনের বিরোধিতা করে।
বেন্দা ও সাইদের সংজ্ঞায় আমরা ফলিত জ্ঞানের শ্লেষ খুজে পাই। যদি ধরে নেই জার্মান দার্শনিক মিশেল ফুকোর বিবরন তাহলে বলা যায় সকল মানুষ বুদ্ধিজীবী অথচ সব মানুষ বুদ্ধিজীবীর কাজ করেনা। বেন্দা আবার অন্য জায়গায় বলছেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী যাজক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত অথচ এরা নিতান্তই দূর্বল ব্যাক্তি। তারা সে বিষয় গুলো উন্মোচন করেন যেগুলো চিরন্তন সত্য কিন্তু সেগুলো পৃথিবীর বিষয় নয়। বুদ্ধিজীবী হিশেবে যদি আমরা আলেম ওলামা সমাজকে নির্দেশ করি তাহলে কার্যত দেখতে পাই আলেম শ্রেণি আদপেই দূর্বল সমাজের অন্তর্ভুক্ত। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের কোন বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে কিন্তু কোনবারই তারা সফল হতে পারে না। আমরা দেখেছি ৫ই মে শাপলা চত্তরে হেফাজতে ইসলামের তের দফা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কেবল তাই নয় সেই আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। এ আন্দোলন পাঁচই মে’র তান্ডপ লিলা বলে গণমাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে নিয়মিত। আমরা নাস্তিক ব্লগারদের ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে আলেম সমাজকে দেখেছি আন্দোলন করতে অথচ তখন কিছুটা সফল হলেও বর্তমানে ব্লগারদের হত্যার প্রসঙ্গ টেনে এনে তাদের কৃত অপরাধের ক্ষালনের প্রয়াস করা হয়। ব্লগারদের হত্যার সাথে কওমী মাদ্রাশার ছাত্রদের জড়িত থাকা প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি দেখতে পাই ভাষ্কর্য মূর্তি ইস্যুতে আলেম ওলামা শ্রেণি ঐক্যবদ্ধ হয়েও নিদেনপক্ষে কিছুই করতে পারেনি। অধিকিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মানাধীন মূর্তি ভাঙ্গার সমেত মাদ্রাশার ছাত্রদের সম্পর্ক প্রমাণিত হয়েছে। উপসংহারে দেখতে পাই আলেম ওলামা বরাবরের মত ব্যার্থ বিপরীত-পক্ষে প্রগতিশীল ভাবধারার জয়লাভ করছে। ইসলামী খেলাফত আকিদাহীন আলেমগণের সম্প্রতি বোধদয় হচ্ছে যে রাজনৈতিক প্লাটফর্মে আন্দোলন ব্যাতিরেকে কোন জাতীয় বিষয়ের সুরাহা করা ঢের মুশকিল। কাজেই বুদ্ধিজীবী আলেমগণ রাজনৈতিক ঐক্যমোর্চায় না আসেন তাহলে বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীলদের জয়লাভ হবে খোদার নির্দেশ (সূরা তওবা ৩৮,৩৯) ।
খ) শিল্প সংস্কৃতি জাতির মন মানুসিকতা বিরচনে গৃহশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। যারা শিল্পি তারাও বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতি ভিন্ন জিনিশ। এটির ব্যাক্তার্থ ব্যাপক। আপেক্ষিকভাবে সংস্কৃতির পরিসর বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ইসলামিস্টগণ ইসলামিক সংস্কৃতির কথা বলেন আর সেকুলারিস্টগণ বাঙ্গালী সংস্কৃতির কথা বলেন। সনাতন ধর্মীয় গোষ্ঠী, সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়,ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এরা সকলেই নির্ভাবনায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অধিকতর অনুশীলন করে থাকেন। বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিনির্মানে প্রথমত সরকার অধিক ভূমিকা পালন করেন। সরকার সাধারণত জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণ করার কথা। যেহুতু সরকার জনগণ বানিয়েছে। অথচ সরকার এক বিশেষ বুদ্ধিজীবী মহল যাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ তাদের নির্দেশনায় জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণ করে থাকেন। এরা প্রগতিশীল দাবিদার। তাদের সম্পর্কে আহমদ ছফা বলছেন, এদের দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনের ভাগ কাপুরুষ, পাঁচভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। ছফা আবার এদের সরকারদলীয় বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত করেছেন।
গ) সরকারদলীয় বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে এডওয়ার্ড সাইদ বলছেন বিংশ শতকের ট্যাগ দিয়ে আমেরিকার সরকারের আলোকে যে, বেতনভুক ব্যাবস্থাপক, সাংবাদিক, শুমারী, সরকারি বিশেষজ্ঞ, তদবিরকারী পন্ডিত, প্রাবন্ধিক, উপদেষ্টা ও নরনারীর সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে থাকে যে নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী আদৌ থাকতে পারেনা। প্রথমে বলি সরকারের দেশ পরিচালনায় উপরোক্ত সকল কিছুই অতীব প্রয়োজন। তদুপরি তাদের সকলকে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিচ্ছে কিনা। তারা কি আদৌ সরকারের কর্মচারী নাকি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নাকি কোন ক্ষমতাশীল দলের কর্মচারি। যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয় তবে কেন সকল জনগণ দল মত নির্বিশেষে সকলের অধিকার রক্ষায় মত প্রকাশ করতে পারবেনা। তাহলে একথা যদি সত্য হয় যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সকলেই সরকারের আজ্ঞাবহ। তদুপরি আমলাতন্ত্র বা রাষ্ট্র ও অনুরূপ সরকারের আজ্ঞাবহ। অতএব একথা সত্য যে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা লালন করতে তারা সক্ষম হলেও পালন করতে কি অক্ষম ? তবে জাতি কি দল মত নির্বিশেষে রাষ্ট্র সরকার থেকে সমান সুযোগ সুবিধা সকল অধিকার আদায় করতে অক্ষম নয়? এ সংক্রান্ত জটিলতা থেকে উদ্ধারের উপায় কি?
২।
ইতালীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক আন্থনীয় গ্রামশি বুদ্ধিজীবীদের দুটি ধরণ ব্যাখ্যা করেছেন তার প্রিজন নোট বুকসে। গ্রামশি প্রথম রকমে ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবীদের কথা বলছেন। এর ভেতর শিক্ষক, প্রশাসক, ধর্ম প্রচারক (তারা বংশপরম্পরায় একি কাজ করেন)। দ্বিতীয় ধরনে বলছেন, জৈবিক বুদ্ধিজীবী। এর ভেতর শ্রেণির সাথে সম্পর্ক (মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে) স্বার্থের হাসিল, অধিক শক্তি অর্জন, নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কাজ করানো। তার মতে জৈবিক বুদ্ধিজীবীরা পূজিবাদী উদ্যেক্তা। বাংলাদেশের ভেতর ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবীদের ভেতর শিক্ষকদের সম্পর্কে আহমদ ছফা বাস্তব কথা বলেছেন, তিনি বলছেন, “আমাদের অর্থনীতির পন্ডিতেরা হার্ভাড থেকে যে অর্থনীতি শিখে আসেন তার প্রয়োগ আমাদের দেশে সম্ভব নয়। অক্সফোর্ড থেকে যে সমাজতত্তের পাঠ নিয়ে বাংলাদেশে আসেন তা বাংলাদেশে অনেকটা মূল্যহীন। হার্ভার্ড অক্সফোর্ডের শিক্ষা-দীক্ষা গবেষণা ইত্যাদি অনেকটা ইংরেজ মার্কিন সমাজের অভিজ্ঞতা, উদ্দেশ্য, শক্তি এবং বাস্তবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে নানাকারণে প্রয়োগ করা তা অসম্ভব হয়ে পরে। তার ফলে আমাদের পন্ডিতেরা অনেক সময় বিদেশী বিদ্যার ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়ে যান।” ব্রিটেন থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রী বাংলাদেশে অকার্যকর। এ সম্পর্কে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ফেসবুকে পোস্ট করলে অনেক নীত ডিগ্রিধারী তিনার উপর গোস্যা হন। বস্তুত এতে আমাদের পশ্চিমা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে যে আমরা এখনো বের হতে পারিনি একথারই প্রমাণ হয়। আমাদের দেশের জন্য কোন ডিগ্রী অধিকতর ফলপ্রসূ সে সম্পর্কে আমাদের জানাশোনারও প্রয়োজন মনে করিনা। আমাদের বাংলাদেশের প্রতিযশা অধ্যাপক আমাদের বিভাগের স্যারের গুরু আহমদ ছফার শিস্য সলিমুল্লাহ খান ইংল্যান্ড থেকে পনের বছর ধরে ইংল্যান্ডের অর্থনীতির (বিগত দুইশত বছর) উপর পিএইচ ডি করেছেন। তাকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয় তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি অবশ্যই ছফার শীর্ষক গ্রন্থটি পড়েছেন। তবুও কেন? তার পিএইচডি এর কৈফিয়ত তিনিই ভালো দিতে পারবেন।
ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রশাসক এবং ধর্ম প্রচারক সম্পর্কে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। এখন জৈবিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা “শ্রেণির সাথে সম্পর্ক” সম্বন্ধে কিছু কথা বলে রাখি। শ্রেণি বললে কার্ল মার্ক্স এর কথা সবার মনে চলে আসে অনভিপ্রেতভাবে। তার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ ভালো দিতে পারবেন।
আমাদের সমাজে কিন্তু এ দ্বন্ধের প্রকাশ্য প্রতিবাদ দেখতে পাইনা। এ প্রতিবাদকে বাম সমাজ বিপ্লব বলে থাকেন। প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সাথে পূজিবাদী শ্রেণির ফারাক বিস্তর অসীম। আমাদের জিডিপি পূজিবাদী ধণিক শ্রেণি সমৃদ্ধ করেছেন। অথচ এ পূজিবাদীদের উত্থান ঠেকানো কি আদৌ প্রয়োজন? এ সমাজের উপর জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি পূজিবাদী প্রতিষ্ঠান গুলো দখল করলে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে কি? আমরা নব্বই এর দশকে এর ব্যার্থতা দেখেছি। চীনা বাজার সমাজতন্ত্র আর রাশান সমাজতন্ত্র নিয়ে হ্রেষাহ্রেষি কি কখনো বাংলাদেশে প্রোলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তি নিয়ে আসবে? মিলবে কি কোটি মানুষের অনাহার থেকে আহারের ব্যবস্থা? বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কি জাতীয়ভাবে কোন গণ আন্দোলন গড়ে তুলবে? শতভাগ সাক্ষরতার হার
কখন বাস্তবায়ন হবে? আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আর উপ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে কি ফারাক কমবে না? চাকুরী পেতে কি শুনতে হবে দশ লাখ টাকা ছাড়া সরকারি চাকরি হয় না? চতুর্থ শ্রেণির চাকরিও কি ঘুস ছাড়া হবে না? অবৈধ ভাসমান রোহিঙ্গাদের জন্য অনিন্দ্যসুন্দর আবাসন কি বাংলাদেশের হতদরিদ্র যারা রাস্তায় ঘুমোয়, শীতের কাপর পায়না তাদের বুকের উপর শেল মেরে নির্মান করা হয়নি? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি কখন বাস্তবায়ন হবে? আদৌ কি তা সম্ভব? পারবে কি এর উত্তর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ?
৪।
সাঈদ বলেন, বুদ্ধিজীবীদের কাজ সমস্যাকে সার্বজনীন করা। একটি বিশেষ বর্ণ কিংবা জাতি যারা কষ্ট পায় তাদের সুযোগের ক্ষেত্র প্রদান করা”। বুদ্ধিজীবীগণ জ্ঞান এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করবেন। বুদ্ধিজীবীগণ হবেন সকল জাত ধর্ম রাজনীতির ঊর্ধে। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কোন রাজনীতির হাতিয়ার হবেন না। একটি বিশেষ বিশেষজ্ঞ সরকারের বুদ্ধিজীবী হিশেবে কাজ করবেন কিন্তু চাটুকারিতা পদলেহন থেকে মুক্ত থাকবেন। তারা জাতীয় গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গন্ডির উর্ধে উঠে মানবতার জয়গানে অবগাহন করবেন। তবে কেন ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদী বলছেন? সরকারি বুদ্ধিজীবীদের ভাড়াখাটা সৈনিক বলছেন? তার বক্তব্য কি ১৯৯৭ সন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো?
এখন কি সেই পরিস্থিতি আছে নাকি উত্তরন ঘটেছে? তাঁর গাভী বৃত্তান্তের উপযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে নয় কি? আমরা দেখছি জবি উপাচার্য যুবলীগের সভাপতি পদ পেলে উপাচার্য পদ ছেড়ে দেবেন জানান। গোপালগঞ্জ এর উপাচার্য নিয়ে নারী কেলেংকারী, জাবি উপাচার্যের অর্থনৈতিক কেলেংকারী, চবির উপাচার্যের বিজয় দিবসের ব্যানার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রাবি উপাচার্যের জয় হিন্দ শ্লোগান। এসব কি গাভী বৃত্তান্তের উপযোগিতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে না ? তবুও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কি মুখে কলা কানে তুলা দিয়েই বসে থাকবে?
৫। ছফা বলেন,”লেখক কবি সাহিত্যিক গর্ভিণী নারীর মত। তাঁরা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার ভ্রুণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন”। সম্প্রতি আমাদের দেশে তিনজন লেখক সাহিত্যের সমঝধার
হয়ে উঠেছেন। তারা হলেন সাদাত হোসেন, কিংকর হাসান, আরিফ আজাদ। তাদের কেউ প্রেম কেউ ধর্ম নিয়ে পরে আছেন। তাদের সাহিত্য জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে কি কোন ভূমিকা পালন করেছেন? বুদ্ধিবৃত্তিক লেখনীর মাধ্যমে সরকার তাদের কারো বই এখনো বাজেয়াপ্ত করলো না এখনো। কিসের লেখক হলেন তারা? যুবক ছেলে মেয়েদের যৌন সুরসুরি বাড়িয়ে, ধর্মের আবেগ দিয়ে আর কয় দিন চলবেন তারা? সাঈদ বলছেন, “আমাদের সমাজের প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের কাজ হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা, অবজ্ঞা করা নয়”। আবার অন্যখানে তিনি বলছেন, বুদ্ধিজীবীরা পানির কাছাকাছি থাকে মাঝেমাঝে পা ডোবায়, অধিকাংশ সময় পা শুকনো থাকে”। এটিকি আদপেই সত্য কথা? নবীন লেখক, কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কি পা সব সময় শুকনোই রাখবেন?
৬। ১৯৭১ সনে জনযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকগণ কোলকাতায় পারি জমিয়েছেন। সেখানে বহাল তবিয়তে আমেরিকার ডলার দিয়ে উন্নত জীবন যাপন করেছেন। অথচ আমেরিকান
অস্ত্র পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর হাতিয়ার হয়ে নিরীহ বাঙ্গালীর বুকের উপর চালিয়েছেন অবাধে। তারা আইয়ুব সরকারের খোরপোষে বেঁচেছেন। তৎকালীন সকল সাহিত্যিক কবি পাকিস্থানের জয়গান গেঁয়ে কত শত কবিতা লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতা গিয়ে ছন্দ নাম নিয়েছেন। কারণ তাদের ধারণা ছিলো যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়
তাহলে পাকিস্থান সরকারের রোষানলে পরবেন না। তাদের ভেতর সীমাহীন কপটতা ছিলো। অথচ তারাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের জয়গান গেঁয়ে কবিতা লিখে মুজিব সরকারের পৃষ্টপোষকতা নিয়েছেন। ছফা এসব কবি সাহিত্যিকদের সমাজের সবচেয়ে নোংড়া মানুষ বলেছেন। তাহলে এখন যেসকল ভিসি জয় হিন্দ শ্লোগান দিয়ে বেড়িয়েও বহাল তবিয়তে থাকেন তারা কি ভারতের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের এজেন্ট নয় কি? ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাথে বেঈমানী করছে নয় কি? দেশে লক্ষ বেকার ভ্যাগাবন্ড বোহেমিয়ান হয়ে যাচ্ছে আর এদিকে হাজারো ভারতীয় নাগরিক চাকরি করছে অবলিলায়। দেশের লক্ষকোটি টাকা পাঁচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ সংকট উত্তরণের উপায় কি?
৭।
সাঈদ বলছেন, “বুদ্ধিজীবী জাহাজডুবি মানুষের মত তিনি জানেন কিভাবে তাকে ডাঙ্গায় উঠাতে হয়”। কবি ফররুখ আহমদ সুন্দর শব্দে তাদের কান্ডারী বলে ডেকেছেন। সমাজ সংস্কৃতির বাহন পত্রপত্রিকা তারা জাতীয় জনমত গঠন করেন। এবং সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করেন। সত্য ও ন্যায়ের সৌধের উপর অটল অবিচল থাকবে পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ও গণমাধ্যম। জাতীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি, বাঙ্গালীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, জাতীয় সমস্যা, সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করবে গণমাধ্যম। অথচ আমরা দেখেছি অনেকগুলো ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের একজন কিছুদিন আগে বিভিন্ন মামলায় হয়রানি করে গারদে পুরে রাখা হয়েছে। অনেক সংবাদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তাক্ত হতে দেখেছি। কিন্তু সংখ্যাটা এতই কম যে নাই বললেই চলে। কেন এত কম? আমরা দেখেছি ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্থান আমলে অসংখ্য পত্রিকা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছিলো সরকার। কিন্তু এখন কেন এত কম বাজেয়াপ্ত হচ্ছে? সংবাদ বুদ্ধিজীবীদের দুএকজন কেন রক্তাক্ত হবে, গারদে যাবে? এডওয়ার্ড সাঈদ বলছেন, “আমার মোদ্দা কথা হলো বুদ্ধিজীবী হলো এমন এক ব্যাক্তি যিনি জনগণের প্রতি, জনগণের জন্য সোচ্চার, মতামত, মনোভাব, দর্শণ উপস্থাপন ও গ্রন্থিবদ্ধ করতে বদ্ধ পরিকর হবেন”। তবে কেন বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক মহল কলম অস্ত্রে জোরালো প্রতিবাদ করছেনা? তারা কি তস্ত্র?
৮।
প্রাচীন গ্রীক পন্ডিত দর্শনের যাকে সমঝদার বলা হয়, প্রথম শিক্ষক সক্রেটিস। আমরা প্লেটোর রচনা পাঠ করলে তিনি যে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সে সম্পর্কে জানতে পারি। সক্রেটিস কে আমরা দেখেছি এথেন্সের আইনসভা মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। তিনি ছিলেন সত্যের প্রতি অটল অবিচল। তার মৃত্যুর কারণ ছিলো তিনটি, এক, এথেন্সীয় প্রথাবিরোধী, দুই এথেন্সের উপাস্য দেবতাদের মানেন না, তিন নিজ ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করছেন। তার মৃত্যুর পর্যালোচনা হয়েছে। মূলত তাঁর এসব কোন দোস ছিলোনা। সেটি আমরা এখন বুঝতে পারছি। সত্য ন্যায়ের সৌধ তখন মৃত্যু ঘটলেও সেটি অনির্বান উজ্জ্বল সত্য ন্যায় হিশেবে শিখরে বেঁচে আছেন। আমরা শেখ মুজিবকে দেখলে জ্বলন্ত প্রমাণ পাই। তাকে এবং তাঁর পরিবারকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলেও তিনি বেঁচে আছেন প্রেরণায়। বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। সত্য ন্যায়ের প্রতিক মিশরের মুরসীকে হত্যা করা হয়েছে। আজ সে দেশের জনগণ জাতীয়ভাবে না বুঝলেও একসময় সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য হিশেবে প্রমাণিত হবেন তিনি নির্দোষ। কাজেই সত্য ন্যায়ের পথে সংবাদমাধ্যম, গণমাধ্যম অটল অবিচল থাকলে, লেখক তার লেখায় সত্যের উপর অবিচল থাকলে ভারত ও পাকিস্থানের এজেন্ট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তাদের হত্যা করবে। পুনশ্চে তারা বেঁচে থাকবে আবহমান কালের ইতিহাসে। শ্রদ্ধায় সত্যের উত্তরসূরী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মনে রাখবে অবনত মস্তকে চিরকাল কিয়ামত অবধি।
চলবে..